মোসাইদ রাহাত ::
সুনামগঞ্জ শুধু একটি ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল নয়। হাওরবেষ্টিত এই জেলাটি জীববৈচিত্র্যের আধার। হাওর আছে বলেই এই জেলার কৃষি আছে। আছে মৎস্য সম্পদের বিশাল ভান্ডার। হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা। কিন্তু দখল-দূষণ ও প্রভাবশালীদের কালো থাবায় বদলে যাচ্ছে হাওরের চিত্র। হাওরের বুক দিয়ে ছুটে চলা নদীগুলো থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, ফসলি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারে হুমকির মুখে হাওরের জীববৈচিত্র্য। এই পরিস্থিতিতে হাওরাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য রক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
ছোট বড় মিলিয়ে সুনামগঞ্জে ১৩৭টি হাওর রয়েছে যা প্রতিদিনই নীরবে হারিয়ে ফেলেছে তার নিজস্ব প্রকৃতি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বদলাচ্ছে ঋতুর চরিত্র, আগাম বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে ফসল, হারিয়ে যাচ্ছে মাছ, পাখি ও অন্যান্য জলজ প্রাণী। তার চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হলো, এসব পরিবর্তনের বিরুদ্ধে খুবই কম কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, নদীগুলো থেকে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন, ফসলি জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার এবং হাওরের মধ্য দিয়ে রাস্তা ও স্থাপনা নির্মাণ হাওরের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। এছাড়াও শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, মানুষের অসচেতনতাও এই অঞ্চলের জন্য বড় হুমকি। অনেক হাওরপাড়ে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন ফেলা হচ্ছে হাওরের পানিতে। এতে জলজ প্রাণী মরে যাচ্ছে, পানির স্বাভাবিক গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে।
তাহিরপুর উপজেলার পাঠানপাড়া এলাকার কৃষক হুমায়ুন আলী বলেন, হাওরের পরিবেশ এখন বদলিগেছে, আগে যেরকম সময়ে আমরা ধান কাটতাম এখন পানি আওয়ার ভয়ে আগেভাগে ধান কাটি লাওয়া লাগে। এছাড়া পাঁচ বছর আগেও শনির হাওরের আশেপাশে বর্ষার শেষে যে পাখির ডাক শুনতাম, এখন আর তা শুনি না। আগের মতো গোলা ভরা ধান হয় না, মাছও কমে গেছে। এছাড়া বছরের পর বছর সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা, ধোপাযান, খাসিয়ামারা, পাটলাই নদী থেকে অবৈধভাবে পাড় কেটে বালু উত্তোলন করে নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে বাড়ি-ঘর, মসজিদ। বসতভিটা হারিয়ে এখন অন্য গ্রামের গিয়ে আশ্রয় নিয়ে থাকছেন অনেকে।
দোয়ারাবাজার উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের বাসিন্দা লোকমান মিয়া বলেন, এই গ্রামেই আমার দাদার ঘর বাড়ির আছিলো সুরমা নদী থাকি ড্রেজার বসাইয়া যে পরিমাণ তারা পাড় কাটিয়া বালু তুলছে, যার কারণে ২০১৭ বন্যার পর থাকি আস্তে আস্তে করি সবই গেছেগি। আমার মতো অনেকে নিঃস্ব হইছে। এই গ্রামেই মসজিদ আছিন এগুলা সব নদী নিয়ে গেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের তিনটি রামসার সাইট রয়েছে যার মধ্যে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর অন্যতম, রামসার সাইটের নিয়মনুযায়ী জলাভূমি চিহ্নিত করে মাছ এবং পাখির আবাসস্থল প্রদান করার কথা ছিল সেই টাঙ্গুয়ার হাওর এখন বিনোদন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইইউসিএন ২০১৫ এর সর্বশেষ রেড ডাটা বুকের তথ্য অনুযায়ী, এ হাওরে ১৩৪ প্রজাতির মাছ, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১৯ প্রজাতির দেশি ও বিদেশি পরিযায়ী পাখি, ২৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১০৪ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যাওয়ার কথা বলা হলেও বর্তমান সময়ে এগুলো ছিটেফোটাও নেই।
সর্বশেষ ২০২৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, ওয়ার্ল্ড বার্ড মনিটরিং ও বাংলাদেশ বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত পাখি শুমারির তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গুয়ার হাওরে ৪৯ প্রজাতির ৪৩ হাজার ৫১৬টি পাখি বিচরণ করছিল। গেল ১০ বছরের পরিসংখ্যানে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৭৭ শতাংশ দেশি ও পরিযায়ী পাখি এখানে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে।
হাওর এরিয়া আপলিফটমেন্ট সোসাইটি-(হাউস) এর নির্বাহী পরিচালক সালেহিন চৌধুরী শুভ বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওর ধ্বংসের জন্য প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে দায়ী। কারণ টাঙ্গুয়ার হাওরকে যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ করা কথা ছিল সেখানে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সমবায় সমিতির নামে বিভক্ত করে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এখানে ইঞ্জিন চালিত পর্যটকবাহী নৌকা প্রবেশে ধ্বংস করা হয়েছে সেখানখার স্বচ্ছ পানি এবং মাছের আশ্রয়স্থলকে এবং সমবায় সমিতির মানুষেরা যে পরিমাণ মাছ এবং পাখি লুটে নিয়ে গেছে সেই ভয়ে এখানে মানুষ ছাড়া অন্যকোন প্রাণী আসে না আসলেও খুব কম। টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকা প্রবেশ বন্ধ করতে এবং সমবায় সমিতিগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে তবে হয়তো টাঙ্গুয়ার হাওর তার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে।
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী ও জলবায়ুকর্মী সোহানুর রহমান বলেন, হাওরের বর্তমান পরিবেশগত বিপর্যয় নিছক প্রাকৃতিক নয়, এটি বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটের একটি প্রতিফলন। অসময়ে পানি ঢুকে পড়া, দেশীয় মাছের হারিয়ে যাওয়া, ধানের ফলন হ্রাস এবং বৃষ্টিপাতের ছন্দপতন, সবই জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়ন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সমন্বিত নীতি, স্থানীয় জনগণের অভিজ্ঞতা ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মেলবন্ধন। হাওরের মানুষ প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানে অভ্যস্ত, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। পরিবেশ ও জীবিকা দুটোকেই একসূত্রে রেখে, হাওরের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রোডম্যাপ তৈরি করা এবং বিনিয়োগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, সুনামগঞ্জের ১০ বছর আগের পরিবেশের সাথে বর্তমান পরিবেশের কোন মিল নেই। পরিবেশ ধ্বংসের জন্য আমরাই দায়ী, কারণ নদী পাড় কেটে বালু উত্তোলন, হাওর দখল করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, অবাধে মাছ পাখি শিকার সবকিছুর প্রভাব হাওরের পরিবেশে পড়ছে। যার কারণে অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা আবার অতিরিক্ত গরম এগুলো এখন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তিনি জানান, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে যার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা এবং প্রশাসনের কড়াকড়ি। প্রশাসন যদি পরিবেশের ক্ষতিকারীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয় তাহলে অন্যরা এমন অপরাধ করার আগে ভাববে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
ঝুঁকিতে হাওরের জীববৈচিত্র্য, দায় কার?
- আপলোড সময় : ২১-০৬-২০২৫ ০৯:০৮:৩৯ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২১-০৬-২০২৫ ০৯:১২:০৯ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ